গল্প- তনুর রবীন্দ্রনাথ

তনুর রবীন্দ্রনাথ
– শুভায়ন বসু

 

তনু কোনদিন সেভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়েনি, বোঝেওনি।শুধু জানত, রবিঠাকুর মানে শুধু কবিতা, গান,গল্প বা নাটকই নয় – রবিঠাকুর ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পরতে পরতে। জীবনের ওঠাপড়া, বড় হয়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ সবেতেই রবিঠাকুর ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন। তনুর মনে হয়, এ যেন একটা জাতির চিরকালের বন্ধন, অন্তরের পরিচয়,কৃষ্টি বা সংস্কৃতি।
ওর মনে পড়ে ছোটবেলায়, রেডিওতে ভেসে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে ঢুকে, মর্মে পৌঁছে যেত, এমনই ছিল তার যাদু। একটু বড় হয়ে স্কুলে ‘সহজ পাঠ’ বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম পেয়েছিল। তারপর নানা ছড়া, কবিতা দিয়ে মানুষটার সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। বিভিন্ন গল্প, গান,নাটক ইত্যাদি দিয়ে আরো গভীরে প্রবেশ করল । ওর বাবারই অফিসে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তনু আবৃত্তি করল ‘দামোদর শেঠ’। তখন ওর বয়স ছয় কি সাত , ও প্রথম হল। বাবা ওকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় মডুলেশনগুলো। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্লাস্টার অফ প্যারিসের ফ্রেমে বাঁধানো, হলুদ সেলোফেনে মোড়া পূর্ণাবয়ব ছবি। সেই পুরস্কার ওর এখনও যত্ন করে তুলে রাখা আছে।
বাবার একটা সঞ্চয়িতা ছিল, মাঝে মাঝে তনু বের করে পড়ত, বাবা নিজেও কখনও সখনও পড়ে শোনাতেন। কখনও শীতের দুপুরের মিঠে রোদে,ছাদে বসে আলগা সময়গুলোয় বাবা-মা আর তনুর সাথে থাকত বাবার একটা বুশ ব্যারন রেডিও। কত অনুষ্ঠান ,কত গান, কত নাটক। সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই লোডশেডিং হয়ে যেত, বাবা রেডিওটা চালাতেন। লম্ফ বা হ্যারিকেনের আবছা আলোয় ওদের তিনজনের ছায়াগুলো দেওয়ালে নড়েচড়ে উঠত আর রেডিওতে বাজত রবীন্দ্রনাথ। বাবা বুঝিয়ে দিতেন গানের এক একটা কথার মানে। তখন শিশুমনে তনু সব বুঝত না হয়ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বোধহয় সেই তখন থেকেই ওর জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। পরে বড় হয়ে তনু যখন কিছুটা রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র বিষয়ক বইপত্র পড়ে ফেলেছে, যখন রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার এক একটা লাইন জীবনের পরম আনন্দ, দুঃখ বা অনুভবে স্রোতের মত ওর গলায় নেমে আসত, তার অর্থ জীবন দিয়ে বোধগম্য হত, হৃদয়ের গভীরে ঢুকে যেত আর ওর চোখ ভিজে যেত; সেই মহানুভব, সেই দার্শনিকতা, সেই ব্যাপ্তি আর জীবনবোধ যখন ওকে ঘিরে ধরেছিল, তখন তনু বুঝতে পারল, ওর ছোটবেলার সেই অনুভূতি কতটা সঠিক ছিল। সত্যিই, বাঙালীর জীবনের শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মনেপ্রাণে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার উপস্থিতি, তিনিই তো রবীন্দ্রনাথ।

স্কুলে তনুর পাশে বসত প্রিয় বন্ধু পার্থ । খুব মেধাবী আর রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত । দুজনে অনেক তর্কবিতর্ক হত । স্কুলের কয়েকজন স্যার আপামর রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন,তারা ওদের জুড়ে দিতেন সেই রবীন্দ্র ফল্গুধারার সঙ্গে। তনু জানে, বাংলা মিডিয়ামে না পড়লে রবীন্দ্রনাথকে কখনও ও এভাবে জানতে পারত না। স্যারেরা পড়াতেন আর ওদের সামনে সেই অজানা রবীন্দ্র জগতের একের পর এক দরজা খুলে যেত।ক্লাসের জানলা দিয়ে দূরের নারকেল গাছের সারির দোল খাওয়া দেখতে দেখতে কি সব যেন ভাবত ,কেউ বকত না। নীচু ক্লাসে ‘আব্দুল মাঝির গল্প’, পরে হাইস্কুলে ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’,’কাবুলিওয়ালা’ গল্প; কবিতার মধ্যে ‘দীনদান’ ,’নববর্ষা’ স্যারেরা যখন পড়াতেন, তনু ঢুকে যেত সেই জগতে। তার ব্যঞ্জনা ,গভীরতা, সেই বয়সে হয়ত পুরোপুরি বোধগম্য হত না, কিন্তু গভীরে কোথাও যেন দাগ কেটে যেত, একটা জমি তৈরি হয়ে যেত।ওর বাবা আবৃত্তি করতেন ‘দুই বিঘা জমি’ বা ‘পুরাতন ভৃত্য’। তনু দেখত, বাবার চোখে জল । বাবা বুঝিয়ে দিতেন লেখার গভীর অনুভূতির জায়গাগুলো। তখনই ও হয়ত ভাবত, একদিন রবীন্দ্রনাথ পড়বে, বুঝবে। বাবা বলতেন “দেখবি , সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন”।
বাবার অসংখ্য বই ছিল, রবিঠাকুরের ওপর নানা বই- প্রবন্ধের। সেসব অতটা না টানলেও গল্পগুচ্ছ,চিঠিপত্র আর রবিজীবনী খুব টানত।আর গান। শুরু হলো গুনগুন করে গান, তারপরে গান শেখা ।একদিন প্রায় সেই সময়েই ওর হাতে এল প্রথম প্রেমপত্র । তাতেও রবীন্দ্রনাথ। শুধু দুটি লাইন “আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে আজি হোক না হারা।” তারপর “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার ।” প্রেম তো হলতনু দেখতে দেখতে বড়ও হল। রবীন্দ্রগান আর কবিতায় নিজের বিভিন্ন চেতনাকে এখন ও খুঁজে পেতে লাগল ধীরে ধীরে। বাবা লেখালেখি করতেন ।বলতেন, “লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো অসম্ভব। ঠিক কোথাও না কোথাও ওনার প্রভাব এসে পড়বেই। নতুন কিছু লিখতে গেলেও দেখি, যা ই লিখতে যাই উনি আগেভাগেই তা অনেক সুন্দর করে লিখে বসে আছেন।” মেঘ ডাকলে আকাশ কালো করে বিদ্যুতের চমক দেখা গেলে ,বাবা গুন গুন করে গাইতেন ” গগনে গরজে মেঘ,ঘন বরষা ” বা “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে, ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যামগম্ভীর সরসা “। তনু বুঝত বাঙালীর সুখে-দুঃখে যে গান, সেই গান ,সেই প্রাণের কথা,মনের কথা এইতো ও পেয়ে গেছে । ওর চাই’ই রবীন্দ্রনাথ ।যেমন না চাইতেও, উনি এসে পড়েন বাঙালীর অনুভবে। বাবা এও বলতেন, “যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের ছবি দেওয়ালে ঝোলানো থাকে না ,তারা মানুষ নয়।”
তারপর শুরু হল ক্যাসেট কেনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট কিনত কম। আধুনিক, হিন্দি গানের সুর ঝংকার টানত বেশী। বাবার কাছে বকুনি খেত ।তবু বয়সটা ছিল কম, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগসূত্রটা আলগা হতে বসেছিল। বয়সের উত্তাপে ওর তখন ভাল লাগত মান্না দে ,হেমন্ত, কিশোরকুমার ,ম্যাডোনা ।পাগল পাগল অবস্থা ।
হঠাৎ তনুর প্রিয় বন্ধু সুনন্দ ওকে দিল ‘শেষের কবিতা ‘ শ্রুতিনাটক। শুনতে শুনতে ও যেন অন্য রবীন্দ্রনাথকে আবারও খুঁজে পেল, এ যেন ওরই কথা। তনু বুঝল বাবা ঠিকই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া উপায় নেই। ‘শেষের কবিতা’য় সৌমিত্রর সেই ‘নির্ঝরিণী’ আবৃত্তি, ওর জীবনের প্রতিদিনকার অংশ হয়ে গেল। খাতায় লিখে রাখতে শুরু করল প্রিয় সব কবিতা, আবৃত্তি করতে চেষ্টা করত সেগুলো ।ফ্যান হয়ে গেল জগন্নাথ- উর্মিমালার। কিনে ফেলল ‘রবিবার’,’শেষ চিঠি’ শ্রুতিনাটক। আবার চমক, আবার রবীন্দ্রমোহ, উনিযে কত আধুনিক, সেদিন ও বুঝতে পারল। ওর জীবনে ,মননে আবার জড়িয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। গানের বা কবিতার এক একটা লাইন শুনে এক এক সময় ওর খুব কষ্ট হত, ভীষণ কষ্ট । গলায় আটকে থাকত সেই কষ্ট । চোখের জল হয়ে তা কখনও বা নেমে আসত, আর তার সঙ্গে সেই সমগ্র অনুভূতিগুলোকে নিয়ে ওকে জড়িয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ।সেই ওর কবিতা লেখার শুরু। খাতাগুলো ভরে উঠত নানা কবিতায়,ছড়ায়।ও সচেতন ভাবে চাইত সেসব যেন হয় রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত।কিন্তু ধীরে ধীরে ও বুঝল গভীরতা ও দার্শনিকতায় সেসব কথা রবীন্দ্রনাথ সত্যিই আগে বলে গেছেন।আরও সুন্দর করে বলে গেছেন।তনু দেখল,বাবার কথাই সত্যি।প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কথাটাই বোধহয় এই বাংলায় আবিষ্কার করে যায়।আবার কখনও বা কারণে অকারণে ওর গলায় উঠে আসত রবীন্দ্রসঙ্গীত, মানেটাও বোঝার চেষ্টা করত।একই গানের ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অর্থ হৃদয়ঙ্গম হয়।ও দেখত আর অবাক হয়ে যেত।সুনন্দ এবার ওকে দিল, তার এক দাদুর ছোট্ট একটা ডায়েরি, যাতে প্রতি পাতায় মুক্তোর মত অক্ষরে উনি লিখে গেছেন এক একটা কোটেশন। পাতায় পাতায় শুধু রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার থেকে নেওয়া কয়েকটি করে লাইন। সেই ডায়েরিটা যেন তনুর কাছে এক মহা মূল্যবান রত্ন হয়ে দাঁড়াল, তাকে নিয়েই কাটত ওর দিনগুলো।ও নিজেও একটা ডায়েরিতে লিখতে শুরু করল বিভিন্ন গান বা কবিতার ভালোলাগা সব লাইন।তারপর বড় হয়ে , কেরিয়ারের লড়াই লড়তে লড়তে,তনুর গান শোনাও গেছে কমে ।রাস্তাঘাটে রবীন্দ্র সঙ্গীত কানে এসে পড়লে শুধু থমকে দাঁড়াত ওর পা। ভাবত , কই, হিন্দি গান শুনে কখনো তো এমন হয় না!তনু বুঝল, বাবা কেন মার মার করতেন চটুল গান শুনতে দেখলেই।
সেদিন বিকেল, তনুর প্রেম ভেঙে গেছে ।শেষমেশ দেখা করে সব চিঠিচাপাঠি ফিরিয়ে দেবার দিন। তনু দেখতে পেল হলদে শাড়ি পড়ে সে আসছে ,চোখ মুখ অন্যরকম ।অনেক কেঁদেছিল নাকি? সে এগিয়ে আসছে, বুকের কাছে ধরা ওরই উপহার দেওয়া ‘শেষের কবিতা’ বইটা। সে বলল, “মানুষটাই যখন চলে গেছে, তখন আর উপহারগুলো রেখে কি লাভ ?এই নাও, সব ফিরিয়ে দিলাম।” শেষের কবিতা বইয়ের প্রথম পাতায় তনুরই লেখা কবিতার ধৃষ্টতা, ভেতরে অসংখ্য হাত চিঠি। সব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? শেষ প্রেমিকা বাস ধরে চলে গেল। তনুর হাতে থেকে গেল “শেষের কবিতা”। সেদিন সেই মুহূর্তে ওর গলায় নয়, মনে ভেসে আসছিল একটাই গান ,”তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম”।তারপর থেকে আজ অবধি যখনই ও গানটা গুনগুন করে গায়,ওর চোখে ভেসে ওঠে এক ধূসর বিকেলবেলা।যেখানে জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় অক্লেশে ফিরিয়ে দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বাসে চেপে চলে যাচ্ছে একটি নিঃস্ব মেয়ে,আর বাসটি চোখের আড়ালে চলে গেলে ধীর পায়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে আরও একটি নিঃস্ব ছেলে ,আর কখনও সে ফিরে আসতে পারবে না সেই মেয়েটার কাছে,যাকে তার চেয়ে বেশী ভাল কেউ কখনও বাসেনি ।

Loading

Leave A Comment